অবন্তিকা হাসে। প্রজাপতির ডানার মতো মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসে। ওর পিঠ
পর্যন্ত নেমে আসা কোকড়ানো চুলগুলো ওর হাসির সাথে সাথে উড়তে থাকে। ওর
কচিমুখে ছোটছোট ধবধবে সাদা দাঁতগুলো হাসির সাথে সাথে ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
ঠিকমতো হিসেব করে মনে হয়, অবন্তিকা মায়ের সৌন্দর্য্যের একশ বিশ ভাগ নিয়ে
পৃথিবীতে এসেছিল। মা থাকলে কি বলতেন কে জানে! মায়েদের কাছে অবশ্য নিজের
চাইতে সন্তানদের সৌন্দর্য্য অনেক বেশি মনে হয়। আমি বসে বসে মা কি করতেন
তা কল্পনা করার চেষ্টা করি। আর অবন্তিকা আমার চারপাশ ঘুরে ঘুরে আমাদের
বেড়ালছানাটাকে তাড়া করে বেড়ায়। অবন্তিকা ওটার নাম দিয়েছে ‘কিপ্পি’। আমি
ভেবে পাই না কিপ্পি আবার কি ধরণের নাম।
খেলতে খেলতে যদিও বা অবন্তি কখনো বাবার সামনে পড়ে যায়, সাথে সাথে তার
মুখের হাসি বন্ধ হয়ে যায়। ছোট্ট এই মেয়েটা কি করে জানি বুঝে গেছে, বাবা
নামের মানুষটা তাকে অসম্ভব ঘৃণা করে। এতটুকু মেয়ে কি করে বুঝল সেটা একটা
রহস্য। তবে জগতের রহস্য নিয়ে ঘাটাঘাটি করাটা ঠিক কতটা ফলপ্রসূ সে
সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নেই। বাবাকে দেখলেই তাই অবন্তি তার দৃষ্টিসীমার
বাইরে চলে যায়। তাকে একনজর দেখে বাবারও মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে,
চেহারায় ক্রুদ্ধতা ফুটে ওঠে।
নিতান্তই ভাগ্যবশে আমাদের খুশির পরিবারটা দু:খপুরীতে রূপান্তরিত হয়েছে।
স্বয়ং আল্লাহ্ ছাড়া আর কারও দোষ দিয়ে সম্ভবতঃ লাভ নেই। আমার বয়স যখন বারো
কি তেরো, তখন মা টের পান- অবন্তিকা আসছে। বাবা-মা বিয়ের সময়ই ছেলে-মেয়ে
হলে কি নাম রাখবেন, ঠিক করে ফেলেছিলেন। অবন্তিকার আসার খবর শুনে চারপাশে
বিপুল উত্তেজনা তৈরী হয়। আমাদের বাড়িতে খুশির জোয়ার ওঠে। বাবা দিনরাত
ব্যস্ত থাকেন এরপর কি কি করবেন তা নিয়ে। এতকিছুর মধ্যেও আমার প্রতি মায়ের
মমতা কমে যাবার কোনও লক্ষণ ছিল না। মা আমাকে সবসময় কাছে কাছে রাখতেন।
হয়তো আমার মনের ভুল- কিন্তু মনে হতো আমার প্রতি মায়ের ভালোবাসা কোন একটা
কারণে অনেক বেড়ে গিয়েছিল।
দিন ঘনিয়ে আসতে থাকলে যখন চারপাশের উত্তেজনা বাড়তে থাকল, তখন কি জানি
কারণে মায়ের মন ধীরে ধীরে নেতিয়ে আসল। আমাকে আর বাবাকে ছাড়া মা আর কাউকে
কাছে ঘেষতে দিতেন না। আমার স্কুল বা পড়াশোনা না থাকলে আমাকে জড়িয়ে ধরে
বসে থাকতেন। কেউ কিছু মনে না করলেও আমার কেমন জানি লাগতে লাগে। তখনও আমি
ছোট, খুব বেশি কিছু বলার বয়স হয় নি। তাই বড়দের সামনে তেমন কিছু বলার সাহস
পেলাম না। শুধু একদিন বাবাকে গিয়ে বললাম।
‘মা’র কিছু একটা হয়েছে।’
বাবা কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর হেসে জবাব দিলেন, ‘এসময়
ওরকম একটু হয়। ভয় পেয়ো না।’ বাবার কণ্ঠে একটা নিশ্চয়তার ভঙ্গি ছিল,
তারপরও আমি ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না।
আমার সন্দেহ্ অমূলক ছিল না। অবন্তিকাকে জন্ম দিয়ে মা মারা গেলেন। ঠিক
অবন্তি জন্মের দু’ঘন্টা পর। জ্ঞান হবার পর মায়ের অবস্থা ভাল ছিল না।
ডাক্তার কাউকে কাছে ঘেষতে দিচ্ছিলেন না। মা অনেক জোরাজুরি করে আমাকে
ভেতরে যাবার অনুমতি নিলেন। মায়ের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল আমি বুঝতে
পারছিলাম। তার কপালে তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম।
মা কষ্ট করে মুখে হাসি টেনে এনে বললেন, ‘অবন্তি-কে দেখে রাখিস।’ আমি
মা-কে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। আমাকে জোর করে টেনে ঘর থেকে বের করতে
হয়েছিল, কারণ আমি আসতে চাচ্ছিলাম না। মা মারা যাবার পরের পাঁচটা দিন আমি
শুধু কেঁদেই কাটিয়েছি। মা-হারানোর কষ্ট এতো বেশি কেন হয় আমি জানি না!
কোন একটা কারণে বাবার মনে বিশ্বাস জন্মে গেলো, অবন্তিকা-ই মায়ের মৃত্যুর
জন্য দায়ী। এরপর থেকেই তার ওপর বাবার এক ধরণের ঘৃণা কাজ করে। মানুষের
বিশ্বাস বড় ভয়ানক জিনিস। বাবা আমাকে খুবই আদর করেন। এখনও। তার কিছু অংশ
আমি ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি- অবন্তিকাকে। অবন্তির পৃথিবীতে মানুষ বলতে-
শুধু আমি। তার খাওয়া, ঘুম থেকে শুরু করে গল্প বলা পর্যন্ত সব কাজ আমাকেই
করতে হয়। বাবা কয়েকবার অবন্তিকে আমার ছোট খালার বাসায় পাঠিয়ে দেয়ার কথা
বলেছিলেন। আমি রাজি হইনি।
অবন্তির বয়স এখন পাঁচ। সে সবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। আমার পড়াশোনার
ব্যস্ততা থাকলেও আমি অবন্তিকে কাছ ছাড়া করি না কখনো। মাঝে মধ্যে মনে হয়
ওর একটা বোন থাকলে বোধহয় আরও ভালো হতো।
বাবার সাথে একদিন রাতে কথা হলো। বাবা আমার সাথে খুব সিরিয়াসলি কথা বলেন।
ঠাট্টা তামাশা আর করেন না তেমন একটা। বাবা বললেন, ‘পড়াশোনা নিয়ে চিন্তা
করেছো কিছু, এরপর কি করবে?’ আমি চুপ করে থাকি, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে।
কি জবাব দেব? মোটামুটি আমার সব বন্ধুরাই দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার
প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্ত আমি কি করব? আমার দ্বারা কি দেশের বাইরে যাওয়া
সম্ভব? বাবা নিরবতা ভাঙলেন, ‘আমার কলিগের সাথে কথা হলো। তার ছেলে কানাডা
যাচ্ছে পড়তে। দেশের যে অবস্থা। আজকাল আর দেশে পড়াশোনা করে কাজ নেই। কি
বলো?’ আমি তারপরও চুপ করে থাকি। আমার কিছুই বলার নেই। মিনিট দুয়েক পর
বাবা আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমি কি ব্যবস্থা করব? তোমার কোন্ দেশ
পছন্দ?’ আমি মুখ তুলে বাবার দিকে তাকালাম। বললাম, ‘আমার পক্ষে দেশের
বাইরে যাওয়া সম্ভব না। অবন্তিকে রেখে।’ আমি কথাটা বলতে চাচ্ছিলাম না।
কিন্তু আর উপায় ছিল না।
বাবার চোখের দৃষ্টির পরিবর্তন হলো। কিছুটা কঠিন হয়ে বললেন, ‘ওকে বোর্ডিং
এ পাঠিয়ে দেব। ওর জন্য তোমার লাইফ তুমি নষ্ট করবে নাকি?’
আমি উঠে দাড়ালাম। ‘আমাকে ছাড়া ও থাকতে পারবে না বাবা। বাইরের পৃথিবী ওকে
বেঁচে থাকতে দেবে না।’ আমার খুব দু:খ হতে লাগল। এখন মা বেঁচে থাকলে কি
করতেন। তার ছোট্ট মেয়েকে বোর্ডিং এ যেতে দিতেন?
বাবাও উঠে দাড়ালেন। ‘আমি কিছু শুনতে চাই না। এক-দুজনের জন্য পৃথিবী থেমে
থাকে না।’ চলে যেতে যেতে বললেন, ‘তুমি মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকো।’ আমার
মলিন হাসি হাসলাম। মুদ্রার উল্টো পিঠ এতটা ভিন্ন? আমি শোবার ঘরে এসে
ঘুমন্ত অবন্তিকার পাশে বসলাম। তার নিষ্পাপ মুখটায় স্বর্গীয় আভা তৈরী
হয়েছে যেন। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে অনেকটাই।
বাবা ঠিক করলেন, আগে অবন্তিকে বোর্ডিং এ পাঠানো হবে। তারপর আমি যাব। আমি
আগেই চলে গেলে ওকে সামলানো মুশকিল হবে। ওকে ব্যাপারটা জানানোর ভার পড়ল
আমার ওপর। আমি তাকে ঠিক সময়ে জানালাম। শুনে অবন্তির ভাবের কোনও পরিবর্তন
হলো না। সে খুশিমনে রাজি হয়ে গেল। আমার কাছে কেমন যেন খটকা লাগল, কিন্তু
আর ব্যাপারটাকে ঘাটাতে গেলাম না।
অবন্তিকে স্কুলে পৌছে দেয়ার পর ওর শিক্ষকের কাছে সবকিছু বুঝিয়ে দিতে হলো।
ছোট্ট অবন্তিকা হাসিমুখে চারপাশ দেখতে থাকে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবার পর
আমার ফিরে যাবার পালা। ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই।
আমি হাটু গেড়ে বসে অবন্তিকে বললাম, ‘আপু, আমি তাহলে যাই?’
অবন্তির হাসি মুছে গিয়ে ভ্রু জোড়া কুঁচকে যায়। ‘তুমি কোথায় যাবে?’ সে জিজ্ঞেস করে।
আমি বলি, ‘এইতো, বাসায়।’ অবন্তিকার চোখ ছলছল করে ওঠে। ‘আমি এখানে একা
থাকব?’ সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে।
আমি হেসে বললাম, ‘একা থাকবে কেন? এই যে, কত কত মেয়েরা আছে। ওদের সাথে
থাকবে।’ অবন্তিকা কাঁদতে শুরু করে। বলে, ‘আমি তোমার সাথে যাবো।’ আমি
অসহায়ের মতো শিক্ষকের দিকে তাকালাম। সে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে ভেতরে নিয়ে
গেল। পরে ফিরে এসে আমাকে জানাল, ‘প্রথম প্রথম এরকমই করে। পরে ঠিক হয়ে
যাবে।’ আমি হাসলাম। একমাত্র আমিই জানি, ঠিক হবে কি-না।
অবন্তিকে স্কুলে রেখে আসার পরদিন রাতে আমার ফ্লাইট। বাবাকে খুব খুশি খুশি
দেখাচ্ছিল। তার অফিসের কয়েকজন সঙ্গে এসেছেন। আমাকে বিদায় জানাতে। আমি
ভাবলাম, এয়ারপোর্টে ঢোকার আগে অবন্তির সাথে একবার কথা বলব।
আমাকে বলতে হলো না। স্কুল থেকে ফোন এল। অবন্তির অনেক জ্বর। স্কুলের
হসপিটাল থেকে স্কয়ারে পাঠানো হয়েছে।
আমার মুখ দিয়ে কথা বের হলো না। শুধু একটা মলিন হাসি ফুটে উঠল। বাবাকে সব
জানালাম। বাবা তার কথায় অটল রইলেন, ‘টিকিট কাটা হয়ে গেছে। এখন আর ফেরার
উপায় নেই। হাসপাতালে যেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। আমরা আছি এখানে।’
আমি হাসলাম। হাহ্। টিকিট!
*
হাসপাতালের বিছানায় অবন্তিকে শুয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। দরজার বাইরে দাড়িয়ে
কাঁচ লাগানো জানালা দিয়ে আমি আর বাবা দেখছি। বোঝা গেল না, বাবা আমার
প্রতি ক্রুদ্ধ, নাকি ক্লান্ত। আমি বললাম, ‘বাবা জানো, মা আমাকে শেষবার কি
বলেছিলো?’ বাবা মুখ তুলে তাকালেন। অধীর আগ্রহে। আমি বললাম। শুনে বাবার
চেহারায় কোনও পরিবর্তন এলো না। ক্লান্ত কন্ঠে শুধু বললেন, ‘ভালবাসতে ভয়
হয় শুধু। হারিয়ে যাবার কষ্টটা অনেক বেশি। তাই আর ভালবাসতে ইচ্ছে করে না।’
জ্বর কমে আসলে ডাক্তার আমাদেরকে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিলেন। আমি অবন্তিকার
মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। সে ঘুম ভেঙে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে ফেলে আর যাবে
না তো ভাইয়া?’ আমি বাবার দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, ‘কোনদিনও না।’ বাবাও ওর
মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘কখ্খনো না।’
অবন্তিকা হাসল। প্রজাপতির ডানার মতো মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসল। ওর কচিমুখে
ছোটছোট ধবধবে সাদা দাঁতগুলো হাসির সাথে সাথে ঝিলিক দিয়ে উঠল।
Next
« Prev Post
« Prev Post
Previous
Next Post »
Next Post »
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon